প্রত্যর্পণ চুক্তি: ভারতের ‘লক্ষ্মণরেখা’ টপকে হাসিনাকে ‘হরণ’ করতে পারবে বাংলাদেশ?
ভারতের ‘লক্ষ্মণরেখা’ টপকে হাসিনাকে ‘হরণ’ করতে পারবে বাংলাদেশ?
২০১৩ সাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি। অর্থাৎ, অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্তকে পরস্পর পরস্পরের হাতে তুলে দেবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও এখনও পর্যন্ত মোট ৭১টি মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশে। এখন ভারতের লক্ষ্মণরেখার মধ্যেই আছেন হাসিনা। প্রত্যর্পণ চুক্তি ব্যবহার করে কি সেই লক্ষ্মণরেখার মধ্য থেকে হাসিনাকে হরণ করতে পারবে বাংলাদেশ?
প্রত্যর্পণ চুক্তি: ভারতের 'লক্ষ্মণরেখা' টপকে হাসিনাকে 'হরণ' করতে পারবে বাংলাদেশ?
প্রতীকী ছবি
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনার ঢাকা ছেড়ে ভারতে আসার পর এক সপ্তাহও কাটেনি। সেই সময়ই নয়া দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে অস্বস্তিকর প্রশ্নটার মুখে পড়তে হয়েছিল বিদেশ দফতরের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় যদি ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করে ঢাকা, তাহলে নয়া দিল্লি কি তা মেনে নেবে? হাসিনাকে তুলে দেবে বাংলাদেশের নয়া শাসকদের হাতে? জবাবে রণধীর জয়সওয়াল বলেছিলেন, প্রত্যর্পণের প্রশ্নটা ‘হাইপোথেটিক্যাল’, অর্থাৎ, পুরোপুরি কাল্পনিক। কাল্পনিক কোনও প্রশ্নের জবাব ভারত দেয় না। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনও জবাব না দিয়ে, এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে, খুব বেশিদিন কি এই প্রশ্নটা ‘হাইপোথেটিক্যাল’ থাকবে? কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ধরনের অনুরোধ কিন্তু ঢাকার তরফ থেকে যে কোনও দিন আসতে পারে। কার্যত সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত কয়েক সপ্তাহে একের পর এক মামলা রুজু হয়েছে বাংলাদেশে। সেই সঙ্গে বাতিল করা হচ্ছে তাঁর কূটনৈতিক পাসপোর্টও। তাহলে কি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি মেনে বাংলাদেশের হাতে হাসিনাকে তুলে দিতে বাধ্য হবে দিল্লি? আসুন জেনে নেওয়া যাক এই চুক্তির আগাপাশতলা।
কী এই বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি?
অনেক ক্ষেত্রেই কোনও একটি দেশের আইনে অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত কোনও ব্যক্তি, বন্দিত্ব এড়াতে অন্য কোনও দেশে আশ্রয় নেয়। ওই ব্যক্তিকে প্রথম দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দুই দেশের মধ্যে অনেক সময়ই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। একেই বলে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি। এই ধরনের চুক্তির আওতাতেই, পলাতক অর্থনৈতিক অপরাধী তথা হিরে ব্যবসায়ী মেহুল চোকসিকে ব্রিটেন থেকে ভারতে ফেরানোর আবেদন করেছে নয়া দিল্লি। একই ধরনের চুক্তি রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেও। তখনও নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসেননি। ২০১৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনা। সেই সময়ই দুই দেশের মধ্যে অপরাধী হস্তান্তরের এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে এবং বাংলাদেশের সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তবে, এরও এক বছর আগে থেকেই এই প্রত্যর্পণ চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন দুই দেশের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী – এস এম কৃষ্ণ ও দীপু মণি। এই চুক্তি অনুযায়ী, ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তর করবে ভারত ও বাংলাদেশ।
২০১৩ সালে প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে এবং বাংলাদেশের সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর
মামলায় জর্জরিত শেখ হাসিনা
হাসিনা বিদায়ের পর বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছে ড. মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর সরকার গঠনের পর থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা রুজু করা হচ্ছে। প্রায় রোজই কারও না কারও অভিযোগের ভিত্তিতে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, শিশুহত্যার মতো গুরুতর অপরাধের নতুন নতুন মামলা রুজু করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৭১টি মামলা করা হয়েছে।
হাসিনাকে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ?
বিএনপি-সহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি হাসিনা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। তবে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও এই বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তবে, এই ধরনের একটা দাবি যে জানানো হতে পারে, সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের সরকারের শীর্ষ কর্তারা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদেশ উপদেষ্টা, তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, হাসিনাকে দেশে ফেরানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করা হবে কিনা, সেই বিষয়ে তাঁর কিছু বলার নেই। হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রুজু হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সেই দেশের স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রক যদি এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলেই তিনি ভারতকে এই অনুরোধ করবেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, “সেই ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যের চুক্তি অনুযায়ী তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে হবে।” তবে, তারপরও কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। তার উপর হাসিনাকে ফেরত চাইলে দুই দেশের সম্পর্কর ক্ষতি হতে পারে। সেই ঝুঁকি সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেবে না।
ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু শেখ হাসিনা
কিন্তু চাইলেই কি মানবে ভারত?
বাংলাদেশ চাইলেই ভারত তা মেনে নেবে, এমনটা নয়। শেখ হাসিনা ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে ভারতের সবথেকে আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ততের মধ্যে অন্যতম। ফলে তাঁকে বিচারের জন্য বা দন্ডিত করার জন্য বাংলাদেশের হাতে ভারত তুলে দেবে, এই সম্ভাবনা কার্যত নেই বললেই চলে। তাছাড়া, বিপদের মুহুর্তে যেভাবে ভারত শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটাই ভারতের নীতি। ভারতকে এভাবেই চেনে গোটা বিশ্ব। হাসিনাকে কখনই আরও বড় বিপদে ফেলতে চাইবে না নয়া দিল্লি। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার পাশে যদি ভারত না দাঁড়ায়, সেই ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যত্রও ভারতের বন্ধু দেশের নেতাদের নয়া দিল্লির উপর থেকে বিশ্বাস টলে যেতে পারে। আস্থা নষ্ট হতে পারে। কূটনৈতিক স্বার্থে ভারত তা চাইবে না।
পাশে দাঁড়ানোর কী উপায়?
পাশে দাঁড়াব বললেই তো হবে না, চুক্তির বন্ধন আছে যে। বাংলাদেশ সরকার যদি শেখ হাসিনাকে ফেরানোর দাবি জানায়, তবে, কূটনৈতিক কারণে ভারতের পক্ষে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হবে না। সেই ক্ষেত্রে রাস্তা আছে দুটি। কোনও টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া। আসলে, এই ধরনের চুক্তিগুলিতে অনেক আইনের ফাঁক থাকে। প্রত্যর্পন চুক্তিতেও এমন কতগুলো বিধান বা শর্ত আছে, যার যে কোনোটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে নয়া দিল্লি। দ্বিতীয় পথ কিংবা, বিভিন্ন আইনি জটিলতা বা মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কারণে বিষয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা।
চুক্তির বিধান
ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল, কোনো ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র অভিযোগের ভিত্তিতে যদি কারও হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হয়, তবে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে। কোন কোন অপরাধকে ‘রাজনৈতিক’ বলা যাবে না, তারও লম্বা তালিকা আছে। যার মধ্যে আছে হত্যা, অপহরণ, অনিচ্ছাকৃত হত্যা, বোমা বিস্ফোরণ, নাশকতা ইত্যাদি। হাসিনার বিরুদ্ধে রুজু হওয়া মামলাগুলির অধিকাংশই হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের। কাজেই, আপাতদৃষ্টিতে সেগুলিকে ‘রাজনৈতিক’ বলে খারিজ করা কঠিন হবে ভারতের পক্ষে। তার উপর চুক্তি অনুযায়ী, কোনও অভিযুক্তর হস্তান্তর চাওয়ার সময়, তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলির সপক্ষে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণও দিতে হয় না। শুধু সেই দেশের আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেই, তাকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরতে হবে। অর্থাৎ, হাসিনার বিরুদ্ধে রুজু হওয়া মামলাগুলির কোনোটিতে বাংলাদেশের কোনও আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে, ওই পরোয়ানার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানাতে পারবে।

Comments
Post a Comment